তাকে আমি প্রথম দেখি মুকুন্দনের মৃত্যুর দিনেই। কালো সারোয়ার কামিজ পরা অল্প বয়সী এক নারী মুকুন্দনের খাটিয়ার পাশে বসে কিছুক্ষণ ক্রন্দনরত। অতঃপর তাকে আর কোথাও দেখিনা আমি। এরপর থেকে আমার মাথায় আর কোনো দৃশ্য নেই। মুকুন্দনকে নিয়ে আমার সমস্ত ভাবনা যেন ওই দৃশ্যটুকুর মধ্যে বন্দী হয়ে যায়। তার উপস্থিতি খুব গভীর ভাবে আমার মাথার ভেতর জায়গা করে নেয়।
কে এই রূপবতী নারী! যে অনিমেষের জন্য কাঁদে! কোনো ভক্ত! নাকি শিষ্য! কিন্তু তাকে দেখে সেরকম মনে হয়নি। তার চেয়েও অনেক কাছের কেউ মনে হয়েছে তাকে। এমনকি আমার চেয়েও অনেক বেশি আবেগ তার দেহভঙ্গিতে। তা আমি ভুলতে পারি না। মুকুন্দনের মৃত্যু দিনটকে আমি ভুলতে পারি না। শত কাজের মাঝে কেবল ওইটুকু দৃশ্যই কেবল ঘুরে ফিরে আসে।
মুকুন্দন আমার অকেশনাল স্বামী। অকেশনাল কারণ সে সবসময় আমার সঙ্গে থাকে না। কারণ একই সঙ্গে নানা ভূমিকায় তাকে রূপায়ন করতে হয়। হ্যাঁ সে একজন অভিনেতা ( এখন মনে হচ্ছে পাকা অভিনেতা) । কাগজে প্রায়ই লেখা হয় অনিমেষ থিয়েটারের জাঁদরেল অভিনেতা। মুকুন্দন আমার দুই সšতানের পিতা, তাদের অভিভাবক, আমার শ্বাশুড়ির প্রিয় দ্বিতীয় পুত্র, সুবীরের বাল্যকালের বন্ধু এবং প্রতিদ্বন্দ্বী। আবার স¤প্রতি পরিচয় হওয়া সাংবাদিক অনিল সাক্সেনার সহকর্মী। মুকুন্দন শখ ছবি তোলা। শখ বললে ভুল হবে। নেশা। প্রায়ই সে তার প্রিয় ক্যামেরাটি নিয়ে বের হয়ে যায়। মানুষের মুখের ছবি ধরে রাখে। ছবি তোলার জন্য কোথায় না যায় সে! রাজস্থানের মরুভূমি, বরফ আচ্ছাদিত হিমালয় । তবে প্রচণ্ড ইগো তার। একই সঙ্গে তার মধ্যে রয়েছে নানামুখী সত্তা। সে খুবই ভাল বস, আবার দেশের পলিটিকস নিয়ে স¤পূর্ণ উদাসীন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে শহরের পুরোনো জিনিসপত্রের বাজার থেকে অ্যান্টিক জিনিসপত্র কিনে নিয়ে আসে। জোকস পড়তে ভালবাসে। তবে এমন জোকসের বই পড়ে যা পড়ে আমার অন্তত হাসি পায় না। যতক্ষণ বাড়িতে থাকে ততক্ষণ ড্রইংরুমের সোফার ওপর গুটিশুঁটি মেরে বাচ্চাদের কমিকস পড়ে। যখন হিচককের ছবি নিয়ে কথা বলে মনে হয় হিচককের ছবি বোঝানোর দায়িত্ব স্বয়ং হিচকক তাকে দিয়ে গেছেন। পোশাকের ব্যাপারে মুকুন্দন খুবই শৌখিন। ব্রান্ডেড শার্ট পরে সবসময়। আর রাতে অবশ্যই বরফকুচি দেয়া হুইস্কির গ্লাসে ঠোঁট তাকে রাখতেই হয়। আমি দেখি হুইস্কির মধ্যে ছোট ছোট বরফগুলো কপারের টুকরোর মতো ভাসছে। হুইস্কি পান করার সময় সে পুরোনো গ্রামোফোন রেকর্ড বাজায়। একই সঙ্গে সে আমাদের সন্তানের জন্য গল্প বানায়।- এই কাজ সে সবসময় করে। সবচেয়ে বড় কথা সে আমাকে বিছানায় যথেষ্ঠ আনন্দ দেয়। হায়! আমি সব বর্তমানকালে কেন বলছি। মুকুন্দন তো আর নেই আমাদের মাঝে!
মুকুন্দন !
তোমার মৃত্যুর পর আমার সবকিছু কি বদলে গেছে!
মুকুন্দনের মৃত্যুর পরই আমি জানতে পারলাম এতোকাল সর্ম্পূর্ণ মিথ্যের মধ্যে আমি বসবাস করে এসেছি। যা আমি ভুলতে পারি না এক মুহূর্তের জন্যও। এই একটি ঘটনা আমাকে এলোমেলো করে দেয়। আমার চেনা জানা পৃথিবীর দরোজা বন্ধ করে দেয় সশব্দে। আমি জানতাম চল্লিশ বছরের জীবনে মুকুন্দন কিছুই লুকায়নি আমার কাছে। তার সেই জন্ম! সেই ছোট্ট একটি শহরের রেলওয়ে কর্মকর্তা বাবা! তার জন্মের সময় সে বাঁচবে, নাকি মাকে বাঁচানো হবে এই নিয়ে ডাক্তারদের মধ্যে যখন চরম টানাপোড়েন তখন মানুষের কাছে ঈশ্বর বলে পরিচিত ড. অলকেষ তাকে এবং তার মা দুজনকেই বাঁচিয়ে দেন। একথা মুকুন্দন কতোবার আমায় বলেছে! লন্ডনে পড়াশোনা করার সময় সালমান রুশদির সঙ্গে একসঙ্গে পাবে বিয়ার খেয়েছে। তখনও সালমান রুশদি অতোটা বিতর্কিত হয়ে উঠেনি। আমি যোগ করতাম। এই নিয়ে তুমি আমাকে গল্পটি একশোবার বলেছ। মুকুন্দন যেদিন মারা যায়, তখন সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা। বাইরে এমন গরম যে রা¯তায় বেরুনো যাচ্ছে না। ধীরে ধীরে রা¯তার সেই গরম আমাদের বাড়ির আঙিনা পেরিয়ে আমাদের ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। সেই সময় কোত্থেকে এক দমকা হাওয়া আসে। মুকুন্দন এবং আমি টেরাসে দাঁড়িয়ে দেখি একটি পরিণত মেঘ জড়ো হচ্ছে ঈষাণ কোণে। পুরোটা সন্ধ্যা যেন গ্রাফিক্স ডিজাইনে করা হয়েছে। আমাদের বাগানের অশোক গাছের শাখা উর্বশির মতো কত্থক নৃত্য শুরু করে দেয়। প্রথম বজ্রপাতের পরই বৃষ্টি শুরু হয়। সঙ্গে শিলাপাত। যে আমি বৃষ্টি দেখে মোটেও আনন্দিত হই না কখনও সেই আমিও বৃষ্টির মোহে পড়ে যাই। আজ ঝড়ের দিনে তোমার অভিসার...আমি গুণগুণ করি। মুকুন্দনকে বললাম, তুমি যদি বৃষ্টি দেখতে চাও তাহলে তোমাকে বিরিশিরি যেতে হবে। মুকুন্দন নি:শব্দে বৃষ্টি দেখতে থাকে। একসময় মুকুন্দন কোনো কথা না বলে আমাদের শোবার ঘরের দিকে চলে যায়। শোবার ঘরের বাইরের দেয়ালে মুকুন্দন ছোটবেলার ছবি। যেদিন তাকে প্রথম মুখে ভাত দেয়া হয় সেদিনের ছবি। ছবিটি এখন অনেক ধুসর হয়ে গেছে- কাকুর কোলে শিশু মুকুন্দন । মুকুন্দন সেদিকে তাকিয়ে আছে। ছবিটির সামনে মুকুন্দন কে দেকে আমার মনে হলো এক শিশু আরেকটি শিশুর ছবি দেখছে। মুকুন্দনের ঘাড়ের পেছনে শয়তানের চোখের মতো একটি কালো দাগ আছে। হঠাৎ আমার ওকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হলো। আমি পেছন দিক থেকে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। মুকুন্দন ছবির দিকে তাকিয়েই বলে উঠে, শিশুদের জীবন কতো সহজ তাইনা? আমি মুকুন্দন কে জড়িয়েই আছি। আমি জানতাম এরপর সে কি করবে! কিন্তু আমাকে চমকে দিয়ে সেসবের ধারে কাছ দিয়েও গেলো না। যখন সে আমাকে পেছনে ফেলে শোবার ঘরে ঢুকল তখন তাকে অনেক দূরের মানুষ মনে হলো আমার। শোবার ঘর থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে বের হয়ে যায়। আমি দেখি গাড়ির হেডলাইটের সামনে বৃষ্টির ধারা গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ঝরে পড়ছে! হেডলাইটের আলো ফুলের গাছের ওপর পড়ে। ওটাই মুকুন্দনকে আমার শেষ দেখা। এরপর তাকে যখন দেখি তখন সব শেষ হয়ে গেছে। দুর্ঘটনার পরে তাকে দেখি কাপড়ের বান্ডিলের মধ্যে। শুকনো, গাঢ় ঠোঁট, প্রাণহীন ঘুম- ঠিক মুকুন্দনের সঙ্গে খাপ খায় না।
আমার শিশুরা তাদের অকেশনাল ফাদার সম্পর্কে কি মনে রাখবে?
হৃষিকেষ যখন দশে পা রাখবে তখন মুকুন্দন মারা যায়। মুকুন্দনের মৃতদেহ দেখে সে আমার চারপাশে ঘুরে বেশ সুরক্ষিতভাবে। হৃষিকেষ আমার আর মুকুন্দন জীবনের একমাত্র যোগসূত্র। আমরা তখন নবীন দম্পতি। বাচ্চা মানুষ করার কিছুই বলতে গেলে আমরা জানি না। বাজার থেকে মুকুন্দন একের পর এক খেলনা কিনে আনত। মুকুন্দন বাদ্যযন্ত্রের মতো শব্দ করতে পারত। হৃষিকেশ যখন বিরক্ত করত তখন মুকুন্দন দুই ঠোঁট স্ফীতস্তনের মতো করে অদ্ভুত শব্দ করত। সেই শব্দে হৃষিকেশ আরো জোরে কেঁদে উঠত। আমার চার বছরের মেয়ে ছোট্ট ডোরি, মুকুন্দন যখন তার দীর্ঘ পরিভ্রমণ শেষ করে বাড়ি ফিরত দরজায় বেল বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে সে দৌড়ে গিয়ে দরোজা খুলে দিত। মুকুন্দন তাকে কোলে তুলে নিত। ওর হাতে থাকত অসাধারণ সব খেলনা আর চকোলেট। শিশুদের হয়তো এরকম দু’একটা স্মৃতি থাকবে।
মুকুন্দন বিদায়ের দিন আমি কেবল দুটো ঘটনা স্পষ্টভাবে মনে করতে পারি। একটি মেয়ে। কালো সালোয়ার কামিজ পরা। সুন্দরী ,দীর্ঘাঙ্গী,লম্বা গলার অধিকারী। বেতস লতার মতো লাগছিল মেয়েটিকে। মুকুন্দনকে যে খাটিয়ায় শোয়ানো হয়েছিল সে সেই খাটিয়ার পা স্পর্শ করল। হাতে করে নিয়ে আসা ফুলগুলি রাখল তার বুকের ওপরে। তারপর সারি সারি শোকার্ত মানুষের মধ্য দিয়ে হেঁটে গেলো। একটু দূরে মানুষের কাছ থেকে সরে গিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। দ্বিতীয়টি আমার আকাক্ষা। ততক্ষণে আনুষ্ঠানিকতা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আমি তখন অস্থির, সেই সমস্ত লোকজনের মতো যারা বিদায়ী ট্রেন যাত্রীদের হাত নাড়বার জন প্রস্তুত। সম¯ত স্মৃতি যেন নি:শেষ প্রায়। এসময় আমার হৃষিকেশ বলে উঠে, গুড বাই আচ্চন। কোনরকম কান্না ছাড়াই। আমি বুঝতে পারলাম একথাটি বলার জন্য সে কতোটা পরিশ্রম করেছে। আমি তার গালে চুমু খেলাম। যা তাকে আত্মসম্বরণের লালিমা এনে দিল।
সেই সন্ধ্যায় যখন সবাই যার যার কর্তব্য শেষ করে চলে গেলো, শুধু আম্মা ছাড়া। আর আমি খুবই নি:সঙ্গ না হয়ে ঘুমে কাঁদা হয়ে গেলাম। কোন কিছুই মনে না থাকা ঘুম কেবল শরীরের ক্লান্তির জন্যই সম্ভব। অথবা মন শরীর কে অন্য একটি জগতে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। পরের দিন সকালে আমি গভীর ঘুম থেকে উঠলাম, অলস চোখে জানালা দিয়ে তাকালাম। তুলো গাছটিতে পাখিদের কিচির মিচির সকাল হওয়া ঘোষণা করছিল। ভোরের সেই বাতাসে তাদের সুর মিশে যাচ্ছিল। হঠাৎ করে আমার মনে হলো মুকুন্দন আমার সঙ্গে নেই। আমি আমার চোখ বন্ধ করলাম। এবং কোনরকম কান্না না করে পুরোপুরি অনুভব করতে চেষ্টা করলাম কি হয়েছে আমার! বেঁচে থাকাকে মৃত্যুর চেয়ে বড় মনে হচ্ছে কেন আমার! সেই অমোঘ বাণী আমার মনে এলো, একে মৃত্যু বলো না। এটা ঠিক যে জীবনের সমাপ্তি হয়েছে বিশেষত মৃত্যুর ভেতরে। আমার মন অপ্রতিরোধ্যভাবে মৃত্যু বিষয়ে কথা বলতে লাগল।
আমাদের কুকুর ব্রুনো আগে যেমন শুয়ে থাকত বিছানার পাশে এখনো তেমনি শুয়ে আছে। হয়তো সেও ভুলে গেছে কিছুক্ষণ আগেও তার প্রভু ছিল। সে শুয়ে আছে কান খাড়া করে। আমি দেখতে পেলাম পোর্চের মাঝে সে শুয়ে আছে। হৃষিকেষ সন্তর্পণে দরজাটা খুলে, তার ক্রিকেট ব্যাটটি নিয়ে আমার রুমে এলো। আর তাকে অনুসরণ করল ডোরি। তারা দ্বিধান্বিতভাবে একবার আমার দিকে তাকাল। আমার মুখের মধ্যে কোনরকম বৈসাদৃশ্য খোঁজার চেষ্টা করে। আমি যেন ইশারায় তাদের অনুমতি দিলাম এমন ভেবে তারা কাঁদতে শুরু করে। আহারে! তারা এখন কাঁদছে তাদের অকেশনাল বাবাকে স্মরণ করে! তাদের কান্না বিস্তৃত হয় আম্মা এবং আমাদের কাজের মেয়েটির মধ্যে।
গতকালের পত্রিকাগুলোতে প্রায় সবাই মুকুন্দন মৃত্যু সংবাদ ছেপেছে। মুকুন্দন শহরের একজন জাঁদরেল মঞ্চ অভিনেতা ছিল। নানান জনের শোকবার্তা। একটি পত্রিকা অবশ্য আমাদের মেয়ের নাম ভুল ছেপেছে। ডোরির নাম ইসাডোরা। সে জায়গায় লিখেছে ঐশ্বরিয়া।
মুকুন্দন যখন আমাদের মেয়ের নাম ইসাডোরা রাখে তখন আমি নিষেধ করেছিলাম।
‘এটা হৃষিকেশের মতো ট্রাডিশনাল নাম নয়।’
‘হৃষিকেশ আমার বাবার নাম। আমরা বাবার নামে সন্তানের নাম রাখার ঐতিহ্য খুব বেশিদিন আগে পাইনি। এটি ঐ চিন্তাধারারই বহি:প্রকাশ। আমি বলমাম আমার ছেলের নাম আমি আমার বাবার নামে রাখব। ’
‘কিন্তু ইসাডোরা’
‘আমাদের মেয়ে ইসাডোরা ডানকানের মতো হবে- সম্পুর্ণ স্বাধীন স্বত্তা নিয়ে বেড়ে উঠবে সে।’
এরপর তিনদিন ধরে মুকুন্দন কেবল ইসাডোরা সম্পর্কে বলতে লাগল। ‘ইসাডোরা তার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নৃত্য করত। নাচের সমস্ত পু্রনো প্রথা ভেঙে ফেলেছিল সে। নাচের মুদ্রা এনেছিল সে গ্রীক দেবদেবীর ভাস্কর্য থেকে। ইসাডোরা কাউকে পরোয়া করত না। সে একের পর এক প্রেমিক পাল্টাতে থাকে। তখন চারদিকে কেবল একটাই নাম ইসাডোরা, ইসাডোরা...’
মুকুন্দন ছিল এরকম। সে তার কথা বাতাসে ছড়িয়ে দিত। ততক্ষণ , যতক্ষণ না সে যা বলছে তা মানা হচ্ছে।
মুকুন্দন মারা যাবার পর এটাই আমার প্রথম স্মৃতি। আমি জানিনা কেন আমার এই স্মৃতিটাই মনে এলো- ডোরির নামকরণ? সে আমার ইচ্ছা শক্তিকে কোথায় চালিত করছে? এটা আমাদের স্মৃতি নির্বাচন যা আমরা আমাদের জীবনী লিখতে ব্যবহার করি। আমি সিদ্ধা্নত নেই আত্ম উৎসর্গের ভুমিকা নেবো। আমি মুকুন্দন খারাপ স্মৃতির কথা মনে করবো না। সেগুলো আমি ধবংস করে দেবো।
আমার সবচেয়ে আনন্দময় স্মৃতি আছে দুই বছর আগের। এটি আমার জন্য মন্ত্রমুগ্ধ এক মে ডে। বাতাস থেকে তখনও ঠাণ্ডা অনুভুতি দূর হয়ে যায়নি। এমন সময় আমার চিকেন পক্স হয়। বালকের ¯স্তনবৃন্তের মতো গোটায় ভরে যায় আমার সারা শরীর। তীব্র জ্বর আমার! মে মাস তার ম্যাজিক দেখানো বন্ধ করলে সত্যিকারের গরম পড়ে। এদিকে আমার জ্বর খুবই বাড়বাড়ির পর্যায়ে চলে যায়। দুই সপ্তাহ একনাগাড়ে সে আমার শয্যাপার্শ্বে বসে থাকে। দুই সপ্তাহ পরে সে ওঠে।‘আমি তোমার জন্য একটি গাছ আনতে যাচ্ছি ।’ সে কিছুক্ষণ পর ফিরে আসে। গরমে তার সমস্ত মুখ তখন লাল হয়ে গেছে।
আমরা এমন একটা জায়গায় থাকি যেখানে কোন গাছ নেই। এখানে কেবল ইলেকটিক খুঁটি। নামেই বসšতনগর। আমি গাড়ি চালিয়ে অনেকদূর গেলাম। সেখান থেকে একটি নিম গাছ এনেছি।’
‘নিম গাছ?’
‘তোমার এখন চিকেন পক্স তাই নিম পাতা সেদ্ধ করে স্নান করতে হবে।’
সেই ঘটনার পর আরো কিছুদিন মুকুন্দন বাড়িতে থাকে। এসময় আমি অনুভব করি হৃষিকেশ কেমন ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে উঠেছে। সারাক্ষণ মুকুন্দন আমার পাশে বসে থাকে। আমাদের শোবার ঘর গাঢ় পর্দায় ঢাকা। যে সময় গুটিগুলো শুকাতে শুরু করে মুকুন্দন আমাকে গা চুলকানো থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করে সবসময়। সে নিমপাতা সেদ্ধ করে স্নান করায়। সে আমার নগ্ন শরীরের দিকে তাকে বলে ওঠে, আমার চিতা বাঘিনী। আর সে হাসত।
আমার শরীর আবার নতুন পাতার মতো সতেজ হয়ে উঠে । আমি যখন আবার গৃহবধূ হলাম আমি দেখলাম মুকুন্দন তার কাপড়চোপড় ভাঁজ করছে। একটি সুটকেসে কাপড়, ক্যামেরা, ফিল্ম রোল ভরছে।
আমি যাচ্ছি। আমি এক সপ্তাহ পর ফিরে আসব।
‘ কোথায় যাচ্ছ?’
‘আমি একা একা কিছুদিন ঘুরতে চাই।’
‘ কোথায় যাচ্ছ?’
আমি ভাবছি রাজস্থানের দিকে যাব।
এই গরমে ঐ মরুভূমিতে কিভাবে যাবে তুমি? আমি অবাক হযে তাকে প্রশ্ন করলাম।
রাস্তাটা ঠিক মরুভূমির মধ্য দিয়ে। আমি একাকি গাড়ি চালাব। শুনেছি সেখানে বেশকিছু হিজড়া থাকে। আমি তাদের ছবি তুলব। আমি একটি এলবাম করতে চাচ্ছি কিছু এরকম মুখ দিয়ে।
তখন গরমের ছুটি। যদিও আমি জানতাম এসময় আমাকে কিংবা বাচ্চাদের সে সঙ্গে নেবে না। যদিও মুকুন্দন কখনও আমাদের অবহেলা করে না। একই সঙ্গে মুকুন্দন নিজের এবং অন্যের স্বপ্ন তার মাঝে ধারণ করে।
মার্চের এক রবিবারে মুকুন্দন মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে ফিরে আসে। কোত্থেকে সে একটি পুরোনো গ্রামোফোন রেকর্ড জোগার করে এনেছে। সম্ভবত সে এটি পেয়েছে পুরোনো জিনিসপত্রের মার্কেটে। সে খুবই আনন্দিত তার এন্টিক গ্রামোফোনটি নিয়ে। এর ফানেল শেপ স্পিকার। এসকময় সে যখন ওটি বাজাতে শুরু করে।
তুমি কি ভলিউমটা একটু কমাবে?
‘এর মাঝে কোন ভলিউম কনট্রোলার নেই।’
হৃষিকেশের পরীক্ষা চলছে।
‘এটি আবদুল করিম খানের মিউজিক।’ অনিমেষ গ্রামোফোন বন্ধ করতে করতে বলল। বাই দ্য ওয়ে হৃষিকেশ পড়াশোনায় কেমন?
‘তুিম জান না? তুমিতো রিপোর্ট কার্ডে সই করো’
‘আমার মনে নেই।’
মুকুন্দন তার গাড়ির চাবি নিয়ে উঠে যায়, হয়তো আবারও কোন লোনলি ড্রাইভে যাচ্ছে। এসময় অনেকটা স্বগতোক্তির মতো বলল, আমি তো একজন অভিনেতা। থিয়েটার করি। থিয়েটার মানে কি? থিয়েটার হলো জীবন। দৈনন্দিন জীবন থেকে নেয়া খণ্ড খণ্ড চিত্র।
একথা বলে যেন সে নিজের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে চায়।
এই অকেশনাল অভিনেতার নাট্যগোষ্ঠী দিল্লি নাটক ফ্যাকটরি প্রতিবছর একটি করে নাটক মঞ্চস্থ করে। তারা তাদের সর্বশেষ নাটক মঞ্চস্থ করেছে কামানি অডিটরিয়ামে। শো মঞ্চস্থ হয়ে যাবার পর আমি বরাবরের মতো সেদিনও মঞ্চের পেছনে সাজঘরে ঢুকলাম তাকে অভিনন্দন জানাতে। আমি মুকুন্দনকে দেখলাম আরো অনেক অর্ধনগ্ন পুরুষদের মধ্যে। তাদের শরীরের ঘাম লাইটের আলোতে চিকচিক করছে। সে তখনও তার অভিনয়ের মধ্যে ডুবে আছে। তার চোখ দুটি অনেকক্ষণ পর যেন স্পট লাইটে জেগে উঠে। মুকুন্দন তার চোখ অর্ধ নিমিলীত রেখেই বলে এই যে এখানে গাড়ির চাবি। বাড়ি যাও।
‘তুমি?’
‘আমরা এখন ময়ুর হোটেলের ডিসকোতে যাব সেলিব্রেট করতে। আমার ফিরতে দেরি হবে।’
অন্য মহিলারা ঠিকই তাদের পুরুষদের সঙ্গে যাচ্ছে, কেবল আমি ছাড়া।
গাড়ি চালাতে গিয়ে আমি সামনে যে ক্যাসেট পেলাম সেটাই চালিয়ে দেই। জোরে জোরে সেটি বাজতে থাকে। এই স্ট্র্যাটেজি আমি আমার ছোটবেলা থেকে ব্যবহার করি। কোনো খারাপ চিšতা মনে এলেই আমি গান বাজিয়ে তা বন্ধ করে দেই। যদি সব পুরুষ তাদের ¯ত্রীদের নিয়ে ডিসকোতে যেতে পারে তাহলে আমার যেতে বাধা কোথায় ? কেন আমি সেখানে অপাঙতেয়? কিন্তু এতো দৃঢ়ভাবে মুকুন্দন আমাকে প্রত্যাখ্যাান করেনি কখনও। কিন্তু এর পর আমি তাকে ঘৃণা করতে পারছি না।
বাচ্চাদের সামনে যাতে কাঁদতে না হয় তাই আমি গাড়িটি রা¯তার পাশে অন্ধকারে পার্ক করি। আমি স্টিয়ারিং হুইলে মাথা রেখে কাঁদতে শুরু করি। পুরুষরা যেমন নিজেদের আড়াল করার জন্য করে থাকে। সে রাতে মুকুন্দন তিনটার সময় বাড়ি ফিরে। সে আমাকে ঘুমšত মনে করে আমার গালে চুমু খেলো। আমি চোখ খুলে দেখি, সে অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সেসময় আমার গাল বেয়ে অবিরল ধারায় নোনাধারা বইতে শুরু করে।
‘ ফেরার পথে আমি তোমার জন্য একটি অর্কিড কিনে এনেছি।’ সেলোফেন পেপারে মোড়ানো ফুলটি সে আমার দুই ¯তনের মাঝখানে রাখল। ফুলটির কলির লম্বা ধারালো হলুদ এবং লাল প্রাšত গুলো আমার সম্পূর্ণ অচেনা। আমি আমার বাহুদিয়ে তার কণ্ঠ জড়িয়ে ধরি। নাটকীয়ভাবে আমি তার হুইস্কি পান করা ঠোঁটে চুমু খাই। সেখান থেকে প্রাচীন ওক গাছের গন্ধ পাই।
শরীরবিদ এবং ঝানু অভিনেতার মতো মুকুন্দনের শরীর যন্ত্রের মতো বেজে উঠে। যদিও সে ছিল দক্ষ প্রেমিক কিন্তু কোথায যেন দুরত্ব অনুভুত হলো।
মনে হলো পেছন থেকে কেউ প্রম্ট করছে আর সে অভিনয় করছে। আর আমি ড্রেস সার্কেলে বসে সে অভিনয় দেখছি। এটা হয় আমি আর সে যখন একসঙ্গে থাকি কিংবা একা একা থাকি তখনও মনে হয় কেউ প্রম্ট করছে আমরা অভিনয় করছি।মুকুন্দনের মৃত্যুর পর আমি আমি অবাক হয়ে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ছিলাম। তাদের চোখ, কপালের ভাঁজ, তাদের অঙ্গভঙ্গি। তাদের মধ্যে শোকের চেয়ে মুকুন্দনের অসময়ে চলে যাওয়ার বিরক্তি। যেমনটা হয়েছিল জন লেনন কিংবা এলভিস প্রিসলির মৃত্যুর পর। যারা এসেছিল তারা সবাই ছিল মৃত অভিনেতার প্রিয়জনের মতো। কিন্তু কাউকে তেমনভাবে এডমায়ার বলা যাবে না। আমার যতদূর মনে পড়ে কেবল একটি কণ্ঠস্বরই আমি শুনতে পেয়েছিলাম, মুকুন্দন বলে ডাকছিল। সেই লম্বা মেয়েটি যার পরনের কালো সালোয়ার কামিজ। যা লতার মতো তাকে বেস্টন করে ছিল।
প্রথমে মনে হলো, মুকুন্দনের ছোটবেলার বন্ধু সুবীরকে বিষয়টি জিজ্ঞেস করি। কিন্তু সুবীর কি করে বলবে? ওদের সঙ্গে আমাদের দেখা নেই বহুকাল। ওটা এখন সম্পর্কের ডুবে যাওয়া একটি অধ্যায়। কিছুদিন ধরে চলার থেমে থেমে চলার পর সম্পর্কটি একবারে শেষ হয়ে গেছে। তাই আমি সাংবাদিক অনিল সাক্সেনাকে জিজ্ঞেস করি। অনিমেষের সঙ্গে বেশ কয়েকবছর ধরে তার ঘনিষ্ট যোগাযোগ ছিল। সে বোধহয় একা ছিল। তাই প্রথম রিংটি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে ফোনটি তুলে।
অনিল, আপনি কি ঐ মেয়েটিকে চেনেন যে মুকুন্দনের শেষকৃত্যের দিন উচ্চস্বরে কাঁদছিল।
না, আমি ভাবলাম আমি তোমাকে বিষয়টি জিজ্ঞেস করবো।
তুমি কখনও তাকে দেখ নাই?
কে হতে পারে? তার অফিসের কেউ? স্টেনো?
নানা আমি তাদের সব্বাইকে চিনি।
‘মুকুন্দনের গ্রুপের কেউ? দিল্লি¬ নাটক ফ্যাক্টরির?’
‘না, সে ওখানকার নয়, আমি তাদের প্রত্যেককে চিনি।’
তারপর আমি রবি মিনহাজকে ফোন করি। মিনহাজ প্রায় নিয়মিতই মুকুন্দনের নাটকের নির্দেশনা দিত। হ্যাঁ, রবি সেই মেয়েটিকে চেনে। তার নাম নলিনী । একটি নাটকের স্কুলের শিক্ষক সে। বয়স টেনেটুনে ২৫ এর বেশি হবে না। ১৯৯৩ সালের ব্যাচ। মাঝেমাঝে সে তার স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে মুকুন্দনের নাটকের রিহার্সাল দেখতে যেতো। কলেজের ভেতরেই একরুমের একটি এপার্টমেন্টে থাকে। কলেজটি শহরের একমাত্র মার্কেটটির পাশে।
আরেকটি শেষ অনুষ্ঠান বাকি আছে মুকুন্দনের মৃত্যুও পর। মুকুন্দন আমার অকেশনাল স্বামী! তার ছবি বড় করে দেয়ালে টানাতে হবে। । আম্মা, আমি এবং সšতানরা মিলে মুকুন্দনের মধ্য পয়ত্রিশের একটি ছবি দেয়ালে টাঙ্গানোর জন্য ঠিক করলাম।ছবিটি এনলার্জ করতে দেয়া হলো।
যখন আমি রমা স্টুডিওতে ছবি এনলার্জ করার জন্য গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলাম তখন হঠাৎ করেই অনুভব করি আমাকে নলিনীর সঙ্গে দেখা করতে হবে। আমি কখন তার দরজায় বেলে চাপ দেই মনে নেই। দরজা খুলে সে যেন অনেকটা ভব্যতার খাতিরেই বলল, আমি জানতাম তুমি আসবে।
রুমটি অনেক বড়। কিন্তু পাতলা কম দামের পর্দা ভেদ করে ভেতরে সূর্যের আলো আসছিল। তাই রুমটিকে আকৃতির চেয়ে ছোট দেখাচ্ছিল।
ঘরের মাঝে কয়েকটি বেতের চেয়ার এবং ম্যাট্রেস এলোমেলো হয়ে আছে। ঘরটির এককোণে একটি ব্রোঞ্জের কলসি। একটি বাতি পুরো ঘরটিকে স্পট লাইট ফেলে মঞ্চের মতো নান্দনিক করে রেখেছে। একটি গোলমতো ক্যাকটাসের পাত্র রাখা হয়েছে ফুলদানির ওপর। তার পাশে মুকুন্দন এবং নলিনির ছবি । থিয়েটার সেটের একটি টেবিলের ওপর কাঠের ফ্রেমে মুকুন্দনের ছবি। তাকে দেখাচ্ছে তিব্বতীয় রিফুজির মতো। লাইট এবং শেডের অলটারনেটিভ ব্যবহার করা হয়েছে এতে। অনেকটা দাবার বোর্ডের মতো।
‘ কেন তোমার মনে হলো আমি আসব?’
‘ কেন, তুমি কি আসতে চাও নাই?’
‘আমি বুঝলাম না।’
‘তোমাকে মুকুন্দন কিছুই বলেনি?’
‘কি?
‘না, কিছু না?’
‘কি? বলে নি আমায়?’ আমার গলা যেন একটু ওপরে ওঠে গেলো।
আমি কি তোমার জন্য একটু চা বানাব? নলিনী বেশ শাšত স্বরে আমাকে জিজ্ঞেস করল।
‘কি? কি বলেনি আমাকে মুকুন্দন ?’ সে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিল। আমি তার পথ রোধ করে দাঁড়ালাম।
‘কিছ ুনা’, নলিনী তার চোখ নামিয়ে বলল।
‘এসব কি?’ আমি তাকে ধরে ঝাঁকি দিলাম।
হঠাৎ নলিনী কেমন যেন দ্বিধান্বিত হয়ে গেলো। আমরা..আমরা প্রেমিক- প্রেমিকা
‘ মিথ্যে কথা।’ আমি কাঁদতে শুরু করলাম।
নলিনী কিছু কাপড় জড়ো করল এবং বাথরুমের দিকে গেলো। যেন আমাকে একা রেখে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে দিয়ে গেল। একটু পরে সে ফেরে। পরনে একটি ময়ুর রঙা গাউন। আমি তার মসৃন লোমবিহীন পা দুটো দেখতে পেলাম। তখনও পায়ে জল লেগে আছে । আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গাঢ় এবং উজ্জ্বল রঙ তার ঠোঁটে এবং চোখের পাতায় লাগায় সে।
‘আমাকে একটি পার্টিতে যেতে হবে।’
কান্না আমার ততক্ষণে অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। সুতরাং আমি আবার ফোঁপাতে লাগলাম। তবে একে বের হতে দেই না। নলিনী আলমারী খুলে একটি পুরোনো নাগাপাড়া নেকলেস গলায় পরে। সবুজ গাউনের সঙ্গে সবুজ রঙের পাথর বেশ খাপ খেয়ে যায়। পুরোনো আবহ এনে দিল তার আধুনিক পোশাকের ওপর। আমি দেখি এটি তাকে অনিন্দ্য সুন্দরী করে তুলেছে। যেন আমি তাকে মুকুন্দনের চোখ দিয়ে দেখতে লাগলাম। মুকুন্দনের একটি অভ্যাস ছিল চোখ ছোট ছোট করে চুলে হাত বুলানো। আমার কান্না আরো জোরে হতে লাগল। এসময় আমি কাঁদছিলাম আসলে ঈর্ষায়। এই অনুভূতি আমার আগে কখনও হয়নি।
‘মুকুন্দন আমাকে এভাবে সাজতে শিখিয়েছে।’ সে এমন ভাবে বলে যেন পড়শির সঙ্গে গালগল্প করছে।
‘কেমন করে?’ আমি তাকে জিজ্ঞেস করাম, জিজ্ঞাসা আমার কান্না থামিয়ে দিল।
‘এমন করে- দাদীমার নাগাপাড়া নেকলেস এর সঙ্গে আধুনিক পশ্চিমা পোশাক। সে এক বলত শেকসপীয়ার স্টাইল।’
‘শেকসপীয়ার স্টাইল? আমি এমনভাবে জিজ্ঞেস করি যেন তাদের ব্যক্তিগত ভোকাবুলারি সম্পর্কে আমার অনেক আগ্রহ।
‘হ্যাঁ মুকুন্দন প্রায়ই বলত, শেকসপীয়ার তার লেখায় প্রচুর শব্দ ব্যবহার করেছে মূল ল্যাটিন থেকে। এর মধ্যে সে ব্যবহার করেছে বিশুদ্ধ ইংরেজী শব্দ। যেমন দাদীমার নাগাপাড়া নেকলেস।
এটাই তাদের অন্তরঙ্গতার সত্যতা.. আমি তাকে ঘৃণা করতে লাগলাম। যেমন সকলে অন্যের ভালোবাসাকে ঘৃণা করে।
‘তোমার কাছে এটা নাগাপাড়া নেকলেস আর আমার কাছে বিধবার আবর্জনা।’
আমার কাছে সে একজন অকেশনাল স্বামী, তোমার কাছে প্রেমিক, আমার কাছে সে এমন একজন যার কাছে আমি টাকা চাইতাম কাগজের লোককে দেয়ার জন্য, মুদির জন্য, ইলেকট্রিক বিল দেয়ার জন্য। তোমার কাছে ছিল সে এমন একজন যে তোমাকে শেকসপীয়ারের ব্যাখ্যা করত। আমার কাছে সে ছিল যে কব্জিতে পারফিউম লাগাতো নতুন ড্রেস পরে, তোমার জন্য সে ছিল কেমন হবে তোমার ড্রেস আপ। তোমার জন্য... আমার জন্য... তোমার জন্য... আমার জন্য...আমি বিড়বিড় করতে করতে গাড়ি চালিয়ে বেঙ্গলি মার্কেট থেকে বের হয়ে এলাম।
মুকুন্দনের ছবি নেয়ার জন্য রমা স্টুডিওর সামনে গাড়ি রাখার সময় কি মনে করে আমি গাড়ি ঘুরিয়ে ফেলি। আমি একের পর এক গিয়ার বদলাতে থাকি। যেন একটির পর একটি সিঁড়ি ভাঙছি। গাড়িটি বিদ্রোহ করে একটা ঝাঁকি দেয়। তারপর চলতে শুরু করে। আমি মান্দি হাউজের সামনে বড় একটা বৃত্ত এঁকে ফিরে আসি।
সে রাতে আমি ঘুমাতে পারি নাই। সেরাতে কেন এরপর অনেক রাতই আমি ঘুমাতে পারি নাই। খালি মনে পড়েছে মুকুন্দন আর নলিনীর নগ্ন দেহ। তারা একে অপরকে জড়িয়ে আছে, হাসছে। তারা যে প্রেমিক প্রেমিকা। আর আমি মুকুন্দনের বিধবা স্ত্রী। মুকুন্দন আমার অকেশনাল স্বামী!
একরাতে দেখি স্লি¬পিং পিল খেয়েও ঘুমাতে পারছিনা। আমি রান্নাঘরের কাবার্ড খুলি। পেয়ে যাই সবুজ রঙা হুইস্কির বোতল। মুকুন্দনের পান করা হুইস্কির অবশিষ্ট অংশ তখনও ছিল তলানিতে। আমি একটি কাচের গ্লাসে হুইস্কি ঢালি। ফ্রিজ থেকে বরফকুচি নিয়ে তা পূর্ণ করি। মাতাল হওয়ার জন্য আমি ড্রইংরুমকে বেছে নেই। যেমন করে অনিমেষ টিভি দেখত তেমন করে আমি সোফায় বসে বন্ধ টিভির দিকে চেয়ে থাকি। কখন পেছনে আম্মা এসে দাঁড়িয়েছে টের পাইনি। আম্মা আমার চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকুনি দিল। এই সব ছাইপাশ কি খাচ্ছ? আমি লাফিয়ে উঠলাম। একঝটকায় আম্মার হাত সরিয়ে দিলাম। বেডরুমে গিয়ে দরোজা বন্ধ করে একর পর এক বালিশ দেয়ালে ছুঁড়ে দিতে থাকি।বুঝতে পারছিলাম বন্ধ দরোজার ওপারে আম্মা দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু দরোজায় করাঘাত করার সাহস তার নেই।
দ্বিতীয়বার নলিনীর সঙ্গে দেখা হয় একটি হোটেলে। কনিষ্ক হোটেলের কফিশপে সে আমাকে কফি খেতে ডাকে। যাব কি যাব না করেও যাই। যাওয়ার সময় আম্মা এবং বাচ্চাদের বলি মুকুন্দনের ছবি আনতে যাচ্ছি। কফি শপের যেখানটায় আমরা বসলাম সেখান থেকে হোটেলের সুইমিং পুল দেখা যায়। নীল সুইমিং পুলে তখন বিদেশি নরনারীর জলকেলি একজন সুদর্শন পেশিবহুল শরীরের যুবক পানি থেকে উঠে এলো। নলিনী সেদিকে তাকিয়ে আছে। কোন দেশের হবে এই যুবক উজবেক নাকি তাজাকি¯তানের? আমি একটু হাসলাম। তারপর নলিনীকে প্রশ্ন করলাম,
‘ আমি তোমাকে দেখতে চাইব এরকম মনে হচ্চিল কেন তোমার?’
আমার প্রশ্নে নলিনী জগতে ফিরে আসে যেন।
‘আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাদের ব্যাপারটি জানতে। কিšতু জীবনে প্রথমবার বুঝতে পেরেছিলাম মুকুন্দন তোমাকে বলতে ভয় পেয়েছে। যা তার মাঝে কখনও ছিল না। আমি বিষয়টি শোধরাতে চাই। মুকুন্দনের পক্ষ হয়ে।
দয়া দেখাচ্ছ? তুমি কে? কার পক্ষ থেকে শোধরাবে? তোমার অকেশনাল প্রেমিকের পক্ষ থেকে?
সে আমার জন্য অকেশনাল ছিল না। সবসময় আমার সঙ্গে ছিল। এমনকি এখনও আছে। তার চোখদুটো জলে ভরে উঠে। হুম..
‘প্রথমবার আমি যখন নাটকে অভিনয় করি সে আমাকে ইন্ডিয়া গেট নিয়ে গেছিল। আমাকে ঘাসের ওপর পা ফেলে হাঁটতে শিখিয়েছে কেমন করে মঞ্চের ওপর হাঁটতে হয়। এরকম অসংখ্য ঘটনা ...যখন আমি রাঁধতে পারতাম না মুকুন্দন করিমের রুমালি রুটি আর মাংসের তরকারী নিয়ে আসত।
‘যখন তুমি অসুস্থ থাকতে? কেমন করত মুকুন্দন তখন?
‘সে ইনা মার্কেট থেকে আধভাঙা চাল নিয়ে আসত। আমার জন্য জাওভাত রাঁধত।
‘সে দিনরাত তোমার হাত ধরে বসে থাকত?’
‘হ্যাঁ, সে ভেজা রুমালে আমার জ্বর কমাতো।’